Saturday, 20 June 2020

ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় (রবিকাশ্যপ) / রামগড়, নাকতলা


ক্কেবারে আনকোরা দৃষ্টিতে এক ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল মনীষীর সম্পর্কে কিছু ছুঁয়ে যেতে সততই ভালো লাগে, আর ভালোলাগা তখনই ভালোবাসায় প্রকাশ পায়, অন্তত আমার, যখন তা আমার মতো সাধারণ ও আপামর বাঙালির জীবন ঘেঁষা হয়। এই লেখাটার বর্তমান সময়কাল এমন একটা হাহাকারের সময়ে দাঁড়িয়ে, যখন মানসিক দৃঢ়তা ও নিজের উপর বিশ্বাস রাখা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। গোটা বাংলার জীবনেই তো বাঙালির শ্বাস নেওয়া। এক অজানা ও উদ্ভট অণুজীবের ক্রমাগত সংক্রমণ বৃদ্ধি ও তাতে মৃত্যু, সংক্রমণ ঠেকাতে দেশজুড়ে লকডাউন, বেকারত্ব বৃদ্ধি, অর্থনীতির অধোগমন…সর্বদাই শুধু বেঁচে থাকার লড়াই, মানুষকে যেন এক ভয়ংকর খাদের ধারে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তার ওপর প্রকৃতির তান্ডব মরার উপর খাঁড়ার ঘা চালিয়ে জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে। ওদিকে সীমান্তে দুই প্রতিবেশীর অন্যায় আগ্রাসন ও তার বিরুদ্ধে দেশের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার লড়াইতে বঙ্গমাতার বীর সন্তানদের শহীদ হওয়ার ঘটনায় বাঙালির জীবনে শুরু হয়েছে এক তীব্র আলোড়ন।

এই আলোড়নের পিছনে স্বাভাবিক ভাবেই দেশের জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের ঘটনা ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অন্যায় আগ্রাসনই একমাত্র কারণ। বহুবছর পিছিয়ে গিয়ে আঠারোশ ছিয়ানব্বই সালের মাঝ ডিসেম্বরের একটা ঘটনাই দেখা যাক। স্বামীজী বহুদিন পরে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে আসছেন। ঐ সময়ে এক ইংরেজ ওনার কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে, বিলাসে ভরপুর পশ্চিমের দুনিয়ায় অতদিন কাটিয়ে নিজের দেশে ফিরে কেমন লাগবে? তাতে স্বামীজী জানিয়েছিলেন যে, তিনি আগে শুধুই ভারতবর্ষকে ভালোবাসতেন, কিন্তু ততোদিনে ওনার কাছে দেশের প্রতিটা ধূলিকণা পবিত্র, দেশের বায়ু পবিত্র, নিজের ভারত এক পূণ্যভূমি, এক তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। এই মানুষটিই বাঙালির হৃদয়ের সম্রাট হয়ে উঠেছিলেন অচিরেই, যা আজও সর্বতোভাবে চিরন্তন।

নিজের প্রায় পনেরো বছর বয়সে স্বয়ং নেতাজীর জীবনেও প্রবেশ করেছিলেন স্বামীজী, একথা নেতাজীই উল্লেখ করেছিলেন। স্বামীজীর লেখা পড়ে উজ্জীবিত হয়েছিলেন নেতাজী, যখন, তিনি তাঁর ছাত্রজীবন অতিবাহিত করছিলেন। এইভাবে দেশমায়ের পরাধীনতার অন্ধকার ঘোঁচাতে ঐ বাঙালির জীবনে স্বামীজীর প্রভাব সর্বজনবিদিত।

স্বামীজী দেশে ফেরার পরে আঠারোশ সাতানব্বই সালের ফেব্রুয়ারির আঠাশ তারিখে শোভাবাজার রাজবাড়ীতে তাঁকে নাগরিক অভিনন্দন জানানো হয়েছিল। পাশ্চাত্যে বিপুল কীর্তি স্থাপনের জন্য এই বাঙালিকে সেইসময় রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুর অভিনন্দন পত্র একটা রূপোর পাত্রে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে স্বামীজী যেন কলকাতার এক অতি সাধারণ ছেলে। সকলকে আহ্বান করেছিলেন জগতের আহ্বানে সাড়া দিতে। সেইদিনের বক্তব্যে দেশের যুবকদের উপর তিনি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ব্যক্ত করেছিলেন। অন্যদিকে সেইসময় যাদের জন্মই হয়নি, তারাও; অর্থাৎ আমার, আপনার মতো আপামর বাঙালি যেন আজও তাঁর সেই চিরশাশ্বত আহ্বান হৃদয়ের গভীরে শুনতে পাই।

যুবদের মধ্যে তিনি ব্রহ্ম শক্তির সঞ্চার দেখেছিলেন। তিনি ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর হৃদয়ের কথা, যে, 'দরিদ্র, সর্বহারা, অসহায় মানুষদের মধ্যে থাকা ঈশ্বর যুব সমাজের সেবা আকাঙ্ক্ষা করেন।' তাঁর আহ্বান বাঙালির মনকে প্রভাবিত অবশ্যই করেছে। বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের পরে বিভিন্ন ক্লাব-সংগঠনের ছেলেরা ছুটে গেছে দুর্গত এলাকায় ত্রাণের সামগ্রী নিয়ে। হাতে হাত মিলিয়ে আজও তারা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এদিকে প্রত্যেকের ঘাড়ের কাছে অভিশপ্ত নিশ্বাস ফেলছে মারণ ভাইরাস।

স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর গুরু শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের কথা, উক্তি, উদ্ধৃতি উল্লেখ করতেন বিভিন্ন সময়ে। বিশেষ করে শ্রীরামকৃষ্ণের কথা, "যতদিন বাঁচি, ততদিন শিখি।" সে প্রসঙ্গে নিজে বলতেন, 'যে সমাজের কিছু শিখবার নেই, তা মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে।' আজকের পরিবর্তিত বঙ্গজীবনেও আমরা প্রতিনিয়ত শিখেই যাচ্ছি। 'মান ও হুঁশ' নিয়ে তৈরী মানুষের জীবন সংগ্রামে এক অদ্ভুত অধ্যায় আমাদের সামনে এসেছে। সেখানে হতাশা ও বিষাদের একফোঁটাও স্থান নেই। এই চ্যালেঞ্জিং অধ্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজকের বাঙালি নিশ্চয়ই মনে করবে ও ইতিমধ্যে করছে সেই বিবেক বার্তা, "হে বীর সাহস অবলম্বন করো; সদর্পে বলো - আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই…ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ…"হে গৌরীনাথ, হে জগদম্বে, আমায় মনুষ্যত্ব দাও; মা, আমার দুর্বলতা কাপুরুষতা দূর করো, আমায় মানুষ করো।"

ভাস্কর চট্টোপাধ্যায় (রবিকাশ্যপ)
























সাহিত্যের সন্ধানে'র সাপ্তাহিক ব্লগ প্রতিবেদন
কৌশিক দে (সম্পাদক )
অমৃতা রায় চৌধুরী, সম্রাট দে , অসীম দাস ( সহ সম্পাদক মন্ডলী )

1 comment:

  1. অশেষ ধন্যবাদ সাহিত্যের সন্ধানে পরিবারকে।

    ReplyDelete