ঠিক এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বিবেকানন্দের প্রভাব বাঙালি তথা বিশ্ববাসীর জীবনে কতখানি- এই বিষয়ে লিখতে বসে প্রথমে নিজেকেই কাঠগড়ায় তুলতে হলো। সবার আগে যে প্রশ্নটা উঠে এল- একজন বাঙালি হিসেবে আমি নিজে কতটা প্রভাবিত স্বামীজির ভাবধারায়? ব্যক্তিগতভাবে আমি নিরীশ্বরবাদী। স্বামীজি বলেছেন- "নিজের উপর বিশ্বাস না এলে ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস আসে না।" তবে কি আমি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী নই! অন্তত তাঁর বাণী মেনে নিলে অর্থটা সেটাই দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু আমি মনেপ্রাণে আত্মবিশ্বাসী। কোনও কাজ শুরু করলে তার শেষ না দেখে থামি না। আমি উদ্যমী, লড়াকু- একথা অন্তর থেকে বিশ্বাস করি। তাহলে? অমি একদিকে যেমন নিজেকে ফেলতে পারি না অন্যদিকে তেমন ঈশ্বরের ঘোরতর বিরোধী- এ এক চরম দ্যোতনা! আমি বিশ্বাস করি সুপার পাওয়ার। আর সেটা সমস্ত জীবের মধ্যেই বিদ্যমান। এও তো প্রকারান্তরে স্বামীজির ভাবনার সাথেই সম্পৃক্ত। আর্থাৎ বৈসাদৃশ্য থাকলেও কোনও একটা বিন্দুতে এসে তাঁর দর্শনের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে আমার ভাবনা। অথচ একথা আমার চেয়ে ভালো কে বলতে পারেন যে তাঁর ভাবসমুদ্রে কতটুকুই বা সাঁতার কেটেছি!
বর্তমানে ক্রমবর্ধমান আত্মহত্যার প্রবণতায়
আমরা বিচলিত। হতাশা আমাদের জীবনে স্লো পয়জনিংয়ের মতো জাঁকিয়ে বসেছে। অথচ স্বামীজি বলেছেন- "নিজেদের বিপদ থেকে টেনে তোলো। তোমার উদ্ধার-সাধন তোমাকেই করতে হবে। ভীত হয়ো না।বারবার বিফল হয়েছো বলে নিরাশ হয়ো না। কাল সীমাহীন, অগ্রসর হতে থাকো, বারবার তোমার শক্তি প্রকাশ করতে থাকো, আলোক আসবেই।" আমরা তাঁর দর্শনকে কতটুকু বুঝেছি? আদৌ তাঁর কথার মর্ম উদ্ধার করতে পেরেছি কি? প্রশ্ন করার সময় কিন্তু এসে গেছে!
আমাদের বুঝতে হবে জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে জমে থাকা কুয়াশাকে। স্বামীজির মতে- "জীবন ও মৃত্যু হচ্ছে একই টাকার এপিঠ-ওপিঠ। উভয়েই মায়া। এই অবস্থাটা পরিস্কার করে বোঝবার জো নেই। একসময় বাঁচার চেষ্টা হচ্ছে আবার পরমুহূর্তেই বিনাশ বা মৃত্যুর চেষ্টা।
একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় বর্তমানে বাঙালির চৈতন্য লোপ পেয়েছে। ভালো আর মন্দ নিয়ে চিন্তা করার চেয়ে আমোদ-প্রমোদের মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে দিতে চাইছে জীবন। সততা, পরিশ্রম, অধ্যাবসায়, একাগ্রতা, দৃঢ়তা- এই শব্দগুলো ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে জীবন থেকে। এক অত্যাধুনিক শর্ট-কাট রাস্তায় ছুটে চলেছে বোধহীন বাঙালি।
আমরা বিবেকানন্দের বাণী, তাঁর আত্মজীবনী কিম্বা তাঁর দর্শনের ওপর আধারিত বই সংগ্রহ করি, পড়ি(?) আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাজিয়ে গুছিয়ে বুক শেল্ফে তুলে রাখি। আর্থাৎ আমরা স্বামীজিকে বাইরে থেকে গ্রহণ করছি বটে কিন্তু তাঁর দর্শন, মননকে আত্মস্থ করছি না। অথচ তাঁর মতো দার্শনিক সমগ্র ভারতে খুব কমই আছেন। দর্শন এক অদ্ভুত মায়াপথ। মানুষ হাঁটে সেই পথে কিন্তু তাকে দেখতে বা চিনতে পারে না। আবার অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে হঠাৎ উপলব্ধি করা যায়- এ পথের হদিশ তো অমুক মানুষটা দিয়ে গেছেন!
সময় এসেছে স্বামীজির আদর্শকে সামনে রেখে নিজের সাথে কথা বলার। আত্মজিজ্ঞাসার।
"ভয়ই মৃত্যু
ভয়ই পাপ
ভয়ই নরক
ভয়ই অসাধুতা
ভয়ই ভুল জীবন
এই বিশ্বের সমস্ত নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা ও ধারণা এই ভয়ের অসৎ শক্তি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে।"
"ভয়"- এই দূষিত শব্দটাকে জয় করতে না পারলে আমাদের মুক্তি নেই। প্রথমত ভয়ের কারণগুলো শনাক্ত করতে হবে। তারপর তার অ্যান্টিডট নিজেদের ওপরেই প্রয়োগ করতে হবে। সে পথও বাতলে দিয়েছেন স্বামীজি-
"সেই বিষয়ই ত্যাগ করো যা তোমাকে শরীর, বুদ্ধি ও আধ্যাত্মিকভাবে দুর্বল করে তোলে।"
পরিশেষে বলা যায়, একথা অনস্বীকার্য যে প্রতিটা বাঙালির ব্যক্তিজীবনের ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক যেদিকেই দৃকপাত করি না কেন-ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। দরকার শুধু আত্মসমীক্ষার।
ময়ূখ হালদার |
সাহিত্যের সন্ধানে'র সাপ্তাহিক ব্লগ প্রতিবেদন
কৌশিক দে (সম্পাদক )
অমৃতা রায় চৌধুরী, সম্রাট দে , অসীম দাস ( সহ সম্পাদক মন্ডলী )